কখনো ভিক্ষা কিংবা কখনো জেলের কাজ। এভাবে প্রায় ২০ বছর ধরে অন্যের বাড়িতে আশ্রয়ে কাটছে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী মস্তফা ভূইয়ার জীবন।

মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করলেও ভাগ্যে জোটেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। বার বার জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধর্ণা দিয়েও পাননি আশ্রয়ন প্রকল্পে একটি ঘর। বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সদস্যরা।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের হলদিবাড়িয়া মস্তফা ভূইয়ার বয়স এখন ৭১ বছর। তিনি জানালেন, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ভারতের বগাপার ট্রেনিং সেন্টারে বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে নোয়াখালীতে দুই মাস যুদ্ধ করেন। সেখান থেকে চট্রগামের পাহাড়ি এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে পাহাড় থেকে পরে তিনি আহত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চলে আসেন তখনকার নিজ এলাকা চট্রগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার কাঠগড় ইউনিয়নে। নদী ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে ২০ বছর আগে চলে আসেন কলাপাড়ায়। পরে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের হলদিবাড়িয়া গ্রামের নুরুন নেহার নামের এক প্রতিবন্ধী নারীর সঙ্গে ঘর বাঁধেন। বর্তমানে পাখিমারা বাজার সংলগ্ন মোসলেম সিকদারের আশ্রিত বাড়িতে পার করছেন মানবেতর জীবন।

তিনি জানান, শরীর সুস্থ থাকলে করেন জেলের কাজ। যখন অসুস্থ থাকেন তখন বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় ভিক্ষাবৃত্তি। আবার ভিক্ষাবৃত্তিতে না নামতে পারলে অর্ধাহারে অনাহারে কাটে তার জীবন। তার এ অসহায়ত্বের কথা বেশ কয়েকবার জনপ্রতিনিধিদের জানালেও আজও ভাগ্যে জোটেনি মুক্তিযোদ্ধা সনদ কিংবা সরকারি কোন সহায়তা।

মস্তফা ভূইয়া জানান, দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে ভারতে ট্রেনিং দিতে যান। সেখানে ভারতীয় সেনা বাহিনীর মেজর নাসীমারাও’র নেতৃত্বে তিনি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, মার একফোর রাইফেল, লাইট মেশিন গান, এসএস এলার, হ্যান্ড গ্রেনেড এসএস থার্টি সিক্স, এনটি ট্যাং মাইন ও গাছকাটা বারুদসহ প্রায় ১৫ টি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে এসে চট্রগ্রামের ৪ নম্বর সেক্টরের মেজর শামিমের নেতৃত্বে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা কুমিরা রেলপথে মাইন পুতে রাখার দায়িত্ব পালন করেন। তবে সেদিন তাদের নেতৃত্বদানকারী মেজর শামিম পাকিস্তানিদের গুলিতে শহীদ হন। ওই দিনই পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে নিচে আছড়ে পরে পায়ে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন। সেদিনের কথা মনে উঠলে এখনও আঁতকে উঠেন মস্তফা। টাকা পয়সা নয় তিনি মরার আগে মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি চান তিনি।

কলাপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার ও প্রবীণ সাংবাদিক হাবিবুল্লাহ রানা জানান, ২০১৪ সালে যাছাই বাছাই শেষে মস্তফা ভূইয়াকে তালিকাভুক্ত করার জন্য আমরা কলাপাড়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড থেকে সুপারিশ পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে আজও সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের গাফিলতিতেই আজ মস্তফা ভূইয়ার এমন দশা।

পটুয়াখালী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা মধু মিয়া জানান, আজ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পিছনে তার অবদান রয়েছে। আমরা তাকে নিয়ে বার বার প্রশাসনের কাছে গিয়েছি কিন্তু কোন ফল পাইনি। আমাদের লজ্জা হয়। জাতি তাকে কিছুই দিতে পারেনি।

কলাপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান রাকিবুল আহসান বলেন, মস্তফা ভূইয়ার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি- তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া তিনি যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তাদের সাথেও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সদস্যরা কথা বলেছেন। এখনো যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের সকল কাহিনী তার মনে আছে। আমার উপজেলা প্রশাসন থেকে তাকে একটি দোকান এবং থেকে একটি বাড়ি নির্মাণ করে দেওয়ার উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। এছাড়া তাকে গেজেটভূক্ত করতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল সহযোগিতা করা হবে। আশা করছি খুব শিগগিরই তার সকল দুঃখ-দুর্দশা ঘুচে যাবে।

কলমকথা/সাথী